শাহ আব্দুল আজিজ জায়েদঃ
সাইপ্রাসে আসার পর জানতে পারি নর্দার্ন
সাইপ্রাসে (তুর্কী সাইপ্রাস) নকশবন্দিয়া
তরিকার একজন বুজুর্গ শায়িত আছেন। উনার নাম
নাযিম আল হক্কানী (র.)। এই কথা জানার পর
থেকে উনার মাজার জিয়ারতে যাওয়ার ইচ্ছা
থাকা সত্যেও যেতে পারছিলাম না। কারণ
নর্দার্ন সাইপ্রাস আলাদা একটা দেশ। সাউথ
সাইপ্রাস (গ্রিস সাইপ্রাস) থেকে নর্দার্ন
সাইপ্রাস যেতে হলে আলাদা ভিসা না
লাগলেও বহির্দেশীয়দের জন্য ইমিগ্রেশনে
রেসিডেন্সি কার্ড ও পাসপোর্ট শো করে যেতে
হয়। রেসিডেন্সি কার্ড আমার নেই। এটা পেতে
তিন মাস সময় লেগে যাবে। তাই মহান এই
বুজুর্গের মাজার জিয়ারত আপাতত হচ্ছে না।

গত ৮ জুলাই সিলসিলা ইসলামিক সোসাইটি অব
সাইপ্রাসের সভা থেকে বিশাল আকারে ঈদ
পূণর্মিলনী অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়
এবং প্রধান অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ
আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার সাবেক
কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এবং আনজুমানে
আল ইসলাহ ইউকে মিডল্যান্ড ডিভিশনের সহ
সভাপতি হাফিজ সাব্বির আহমদ সাহেবকে
আমন্ত্রণ জানানো হয়।

৪ আগস্ট শ্রদ্ধেয় সাব্বির ভাই সাইপ্রাসে
আসেন। উনার থাকার ব্যবস্থা করা হয় আমাদের
বাসায়। সাব্বির ভাই নাযিম আল হক্কানীর
মাজার জিয়ারত এবং তাঁর খলিফা ও জামাতা
শায়খ হিশাম আল কাব্বানির সাথে সাক্ষাতের
যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। আমি ভাইকে
বললাম আমারও যাওয়ার ইচ্ছা আছে কার্ডও
পেয়েছি মাস খানেক আগে। উনি বললেন ঠিক 
আছে আমরা এক সাথে যাব।
৭ আগস্ট লারনাকাস্থ উম্মে হারাম (রা.) এর
রওদ্বা জিয়ারত করে (এই সময় একজন খ্রীষ্টান
লোক ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন এবং তার নাম
রাখা হয় আব্দুর রহমান) মাগরিবের নামাজ
নিকোশিয়া উমরিয়া জামে মসজিদে আদায়
করি। মাগরিবের নামাজ আদায় করে
বাংলাদেশী ড্রাইভার ফয়সল ভাইকে নিয়ে
সাব্বির ভাই, আমি, আব্দুস সালাম সুইট ভাই,
আখলাক মিয়া ভাই আমরা শায়খ নাযিম আল
হক্কানী (র.) এর মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে
রওয়ানা হলাম। উইকিপিডিয়া থেকে মাজারের
অবস্থান জেনে নেই। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ
করে লেফকশিয়া থেকে লেফকের (উনার
মাজার লেফকে অবস্থিত) দিকে যেতে
লাগলাম। লেফকশিয়া থেকে লেফকের দূরত্ব ৬৫
কিলোমিটার। গাড়িতে বসে বসে আমরা
সাব্বির ভাইর কাছ থেকে মুসলমানদের ইতিহাস
ও ঐতিহ্য সম্বলিত ঘটনা ও আউলিয়ায়ে
কেরামদের বিভিন্ন কারামত শুনছিলাম। লেফক
শহরে পৌছার পর আমরা মানুষদের জিজ্ঞাস
করে করে মাজারে পানে যেতে লাগলাম।
নাজিম আল হক্কানীর মাজারে যাব, রাস্তাটা
কোন দিকে? এই কথা বলার সাথে সাথে অনেক
আন্তরিকতার সাথে সবাই রাস্তা দেখিয়ে
দিচ্ছিল। কেউ বা আবার একটু এগিয়ে দেয়।
তাদের এই আন্তরিকতা দেখে আমাদের
বোধগম্য হতে বাকি রইল না যে, সেখানকার
লোক কতটুকু আউলিয়া প্রেমী। পাঠকদের
জানার জন্য একটি কথা বলা দরকার, গ্রিক
সাইপ্রিয়টদের বেশিরভাগই গ্রিক অর্থোডক্স
চার্চের সদস্য এবং তুর্কি সাইপ্রিয়টদের
বেশিরভাগই মুসলিম।

মাজারে পৌছার ২/৩ কিলোমিটার বাকি।
আমরা কোন দিকে যাব বুঝে উঠতে পারছিলাম
না। এমন সময় দেখলাম রাস্তার পাশের একটি
রেস্টুরেন্টের বাহিরে বসে কয়েকজন লোক
কফি পান করছিল। তাদের সাথে ১৪ বছর বয়সী
একটি ছেলে ছিল। ছেলেটির নাম মোহাম্মদ
ইবরান। তাদের কাছে জানতে চাইলাম
মাজারের রাস্তা কোন দিকে? তারা মাজারের
তথ্য দিচ্ছিলেন তাদের ভাষায়। তারা ইংরেজি
বুঝেন না আমরাও তাদের ভাষা (তুর্কি ভাষা)
বুঝি না। ইবরান দোকানের ভিতর থেকে তার
বাইসাইকেল নিয়ে আসল। সারথির মত সে
আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। টেক্সিতে বসে আমরা
তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। আমাদেরকে সে
মাজারে নিয়ে আসার পর নামাজের স্থান,
টয়লেট এবং অজুখানা দেখিয়ে দিয়ে বিদায়
নিয়ে চলে গেল। ইবরানের অতিথিপরায়ণ
ব্যবহারে আমরা খুবই মুগ্ধ হলাম।
ঘড়িতে সময় তখন রাত সারে ১০ টা। মাজারে
বিভিন্ন দেশের লোকের সমাগম পরিলক্ষিত
করলাম। যেমন পাকিস্তান, চিন, ফিলিস্তিন,
সিরিয়া, তুরস্ক, লেবানন এই সকল দেশের লোক
বেশি। মাজারে কোন কোন লোক জিয়ারতে
ব্যস্ত, নামাজের স্থানে কেউ নামাজ পড়ছেন,
মাজারের হল রুমে কিছু সংখ্যক লোক
প্রজেক্টরের মাধ্যমে শায়েখ নাযিম আল
হক্কানী (রহ.) এর নসিয়ত শুনছেন। আমি সাব্বির
ভাইকে বললাম, ভাই মনে হচ্ছে আমরা
শাহজালাল (র.) এর মাজারে এসেছি।
পাশ্চাত্যের দেশে মানুষদের ধর্মপরায়ণতা
আমাদেরকে রীতিমত আশ্চর্য করেছে। তা
কেবল সম্ভব হয়েছে মহান আউলিয়া নাযিম আল
হক্কানী (রহ.) এর সহবতের বিনিময়ে।
অজু করার পর আমাদের পরিচয় হয় পাকিস্থানি
নাগরিক মোহাম্মদ আব্দুর রহমানের সাথে। তিনি
তিন বছর থেকে এখানে খাদিম হিসেবে আছেন।
উনার সাথে পরিচয় হওয়ার পর উনি বললেন,
মেহমানদের জন্য খাওয়া ধাওয়া এবং থাকার
ব্যবস্থা আছে। আমরা প্রথমে ইশার নামাজ
আদায় করে মাজার জিয়ারত করলাম।
জিয়ারত শেষে আমরা কিছুক্ষণ প্রজেক্টরে
শায়েখের বয়ান শুনলাম। বয়ানের প্রতি
আমাদের মন এতই আছর হলো যা বুঝাবার
সক্ষমতা আমার নেই।
ওলি আল্লাহ কারা? এমন
একটি প্রশ্নের জবাব পেয়েছিলাম আল্লামা
হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী সাহেবের বয়ান
থেকে। উনি রেফারেন্স সহকারে বলেছিলেন,
যাদের কথা শুনলে ও মুখের দিকে থাকালে
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা স্মরণ হয় তারাই
ওলি আল্লাহ। ছোট সাহেবের এই বয়ানের
সামাঞ্জস্য পেলাম শায়েখের ভিডিও বয়ান
দেখে। কেন বারবার এই চেহারার দিকে
থাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা হয়? কেন পাপী মন
বারংবার প্রতিজ্ঞা করছে, আর কোন পাপ
কাজে লিপ্ত হবে না? এটাই তো আউলিয়ায়ে
কেরামদের প্রতি সাধারণ মানুষের আকর্ষণ।
মৃত্যু বরণ করার পরও মানুষ তাদের প্রতি
ঝুঁকতেছে এটাই তো কারামত। এই কারামতই
আউলিয়াদের বিশেষণ বহন করে।

শায়েখ নাযিম আল হক্কানী (র.) এর দৌহিত্র
মোহাম্মদ নাযিম আদিল সাহেবের সাথে
সাক্ষাতের জন্য উনার হুজরায় গেলাম। উনি
একটি ঔষধ বানাতে ব্যস্ত ছিলেন। আমরা
বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং আল্লামা
ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (র.) এর মুরিদ এ কথা
বলার পর উনি দাঁড়িয়ে আমাদের হাতে চুমা
খেলেন এবং বসার জন্য অনুরোধ জানান।
মোহাম্মদ নাযিম আদিল সাহেব ভারতীয়
উপমহাদেশের অনেক আউলিয়ায়ে কেরামদের
খেদমতের কথা আমাদের বলেন যেমন আব্দুল হক
মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.), আব্দুল আজিজ
মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) ওয়ালিউল্লাহ
মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) এবং সৈয়দ আহমদ শহীদ
বেরলভী (র.), কারামত আলী জৈনপুরী (রহ.), নুর
মোহাম্মদ নিজামপুরী (র.) সহ আরো অনেক
আউলিয়াদের নাম উল্লেখ করে বলেন আমরা
সবাই একি তরিকার।

১৫ জানুয়ারি ছাহেব কিবলাহর ঈসালে সওয়াব
মাহফিলে মোহাম্মদ নাযিম আদিল সাহেবের
পিতা এবং শায়খ নাযিম আল হক্কানী (রহ.) এর
খলিফা শায়খ হিশাম কাব্বানী সাহেব,
জিব্রাইল হাদ্দাদ এবং স্টিফ্যান সুলেমান
স্যোয়ার্টজের হেবগন এদের মাঝে যেকোন
খলিফাকে আসার আমন্ত্রণ জানান সাব্বির
ভাই। সাথে এও বলেন যে, সৈয়দ শায়েখ আসিম
আদি ইয়াহিয়া, শায়েখ ইসুফ হাসেম রেফাঈ, ড.
আবু লায়লা, ক্বারী ইয়াসির আব্দুল বাছিত,
শায়েখ তাহির আল কাদরীসহ বিশ্বের প্রখ্যাত
বুজুর্গরা আমাদের দরবারে তাশরিফ নিয়েছেন।
উত্তরে মোহাম্মদ নাযিম আদিল সাহেব জানতে
চান, আপনাদের দরবারে মিলাদ হয় তো?
সাব্বির ভাই উত্তর দেন জ্বি হয়। মিলাদ এবং
কিয়ামের জন্য আমাদের পীর ও মুরশিদ নিজ
জন্মভূমিরে রক্ত ঝরিয়েছেন। উনার রক্তের
বিনিময়ে আজ বাংলাদেশে মিলাদ কিয়াম
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মূহূতের মাঝে আমি কল্পনায়
চলে যাই, আমাদের দেশে কিছু জ্ঞানপাপী
আলেমরা মিলাদ কিয়ামকে নাজায়েজ এবং
বিদয়াত ফতোয়া দেয় অথচ যাদের হাত ধরে
বহির্বিশ্বে ইসলামের খেতমত আঞ্জাম হচ্ছে,
ইউরোপ ও আমেরিকায় হাজার হাজার মসজিদ
এবং মাদরাসা নির্মাণ হচ্ছে তারাই মিলাদ
কিয়াম আদায় করছেন অত্যন্ত খুলুসিয়তের
সাথে? ধিক সেই সকল স্বঘোষিত মুখস্ত বিদ্যার
আলেমদের।
মোহাম্মদ নাযিম আদিল সাহেব ফুলতলী ছাহেব
ক্বিবলাহর শত শত মসজিদ ও মাদরাসা নির্মাণ,
নিজ বাড়ীতে এতিমখানা (যেখানে ২ হাজার
এতিম আশ্রিত), লঙ্গরখানা, দেশে এবং
বিদেশে দারুল কেরাত প্রতিষ্ঠা (যা প্রায় তিন
হাজার শাখা নিয়ে বিস্তৃত) সহ সকল খেদমতের
প্রশংসা করেন। উনি বলেন আপনারা যে
দাওয়াত দিয়েছেন আমার মোহতারাম ওয়ালিদ
সাহেবকে বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য, আমার
ওয়ালিদ বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থান
করছেন। আমি উনার সাথে আলোচনা করে
আপনাদের জানাব। মোহাম্মদ নাজিম আদিল
আমাদের ফোন নাম্বার ও ইমেইল এড্রেস রাখেন
এবং উনার ফোন নাম্বার ও ইমেইল এড্রেস দেন।
সব শেষে উনি আমাদের খাবারের অনুরোধ
জানান। আমরা খাওয়া ধাওয়া করে উনার কাছ
থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার প্রস্তুতি
নিলাম। কিন্তু মন তো আসতে চায় না। ওলির এই
মাজারে এসে যে শান্তি পেয়েছি সেই
শান্তিটা উপভোগ করতাম শাহজালালের
মাজার এবং পীর ও মুর্শিদ আল্লামা ছাহেব
কিবলাহর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা
নিকোশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। কিন্তু
মন মাজারেই পড়ে রইল। আজ মহান এক ওলীর
দরবারে হাজিরা দিলাম, যিনি ছিলেন ২১
শতকের অন্যতম মুজাদ্দিদ। যার সংস্কার
আন্দোলনের কারণে ইউরোপ ও আমেরিকার
দিশেহারা লক্ষ লক্ষ মানুষ পেয়েছে পথের
দিশা। এমনি একটি ঘটনা হলো, তুরস্কতে একদল
স্বার্থান্বেষী আলেমরা তাদের ভাষায় আজান
দেওয়া শুরু করে দেন। ভ্রান্ত এই ফেরকাকে
উৎখাত করতে একক ভূমিকা পালন করেন মহান
মনিষী নাযিম আল হক্কানী (র.)। এরকম অনেক
পাহাড়সম ফেতনাকে সমাজ থেকে উপরে
ফেলার স্বীকৃতি স্বরূপ মহান এই মুজাদ্দিদকে
২০১৩ সালে দ্যা ফাই হান্ড্রেড মোস্ট
ইনফ্লুয়েন্সিয়াল মুসলিমস নামক একটি বার্ষিক
প্রকাশনার জরিপে বিশ্বের সর্বাধিক প্রভাব
বিস্তারকারী ৫০০ জন মুসলমানের নামের
তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে।
গাড়িতে বসে আছি কিন্তু মনের মাঝে একটি
আলোচনা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে, প্রতি
শতাব্দীতে একেক দেশে, একেক অঞ্চলে রব্বে
করিম প্রদত্ত এসকল মুজাদ্দিদরা যদি একজন
মাত্র মানুষ হয়ে দুটি মাত্র হাত ও দুটি মাত্র
চোখ নিয়ে ইসলাম এবং সমাজ সংস্কারে
উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেন তাহলে
আমরা উনাদের কোটি কোটি অনুসারীরা দ্বিগুণ
হাত ও চোখ নিয়ে কেন সামান্য অবদান রাখতে
পারব না? কেন উনাদের রেখে যাওয়া মিশন ও
ভিশনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সময়
ব্যায় করব না? তাঁদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার
হাজার ভাগের এক ভাগও কি আমাদের পক্ষে
করা সম্ভব নয়?
এমন চিন্তা করতে করতে চলে আসলাম
লেফকশিয়া ইমিগ্রেশনের কাছাকাছি। সাব্বির
ভাই বললেন, সময় যদি পাও তাহলে মাঝে মধ্যে
মাজারে গিয়ে উনার উছিলায় আল্লাহর কাছে
চেয়ো। সব হতাশা ও জঞ্জালকে আল্লাহ সহজ
করে দিবেন। সাব্বির ভাইয়ের কথায় মাথা
নেড়ে হ্যাঁ বললাম আর মনে মনে বললাম, সম্ভব
যদি হত তাহলে সপ্তাহে কমপক্ষে একবার হলেও
মহান এই ওলির মাজার জিয়ারতে যেতাম।
সাব্বির ভাই বলেছেন, কিছুদিন পরে আবার
সাইপ্রাসে আসবেন তিনি। আবারো কলিজা
ঠান্ডা করার জন্য মহান এই ওলির নজরে করম
হাসিলের সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, আনজুমানে আল ইসলাহ,
সাইপ্রাস।
 
Top