তিনি যখন সদ্য প্রয়াত সাদিকের
বাড়ীর আঙিনায় পৌঁছালেন, তখন
দেখতে পেলেন; ঘরের চালায় স্থানে
স্থানে শুকনো কলাপাতা ভাঙ্গা
চাটাইর টুকরোগুলি পড়ে আছে।
বেচারা সাদিক বৃষ্টির প্রকোপ থেকে
ঘরটিকে রক্ষার জন্য গত বর্ষা মৌসুমে
প্রাণপন চেষ্টা করেছে। ঘরের সামনে
আমড়া গাছ তলে দু'আটি ছন দেখে
জিজ্ঞেস করলেন: হে পিতৃহারা
সন্তানেরা, তোমাদের এগুলি কে দান
করেছে?
তারা (এতিমেরা) বলল: আমাদের
বাবা তার মৃত্যুর একদিন পুর্বে জৈন্তা
পাহাড় থেকে এই দু'আটি ছন এনেছেন।
এ কথা বলার সাথে সাথে তারা
কান্নায় ভেঁঙ্গে পড়ল। দরবেশ তাদের
চোখের পানি মুছে শান্তনা দিয়ে
কোলে টেনে নিয়ে বললেন,
তারপর.....?
তারপর.... বাবা সন্দ্ব্যা বেলা ঘরে
ফিরে মাগরিবের নামাজ আদায়
করেন। নামাজ শেষে কাঁপতে থাকেন,
মা আমাদের বললেন বাবা ভীষন জ্বরে
আক্রান্ত । বাবা পুরনো চাঠাই
বিছিয়ে শুয়ে পড়েন এবং মা তার
পাশে বসে চিরুতার পানি মুখে দিতে
থাকেন। এ দৃশ্য অবলোকন করে করে
আমার নিদ্রা যাই। শেষ রাতে মা
আমাদের সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে
বাবার সামনে বসান। বাবার কম্পিত
গরম হাতখানা মা একে একে আমাদের
মাথায় তুলে দেন। বাবা আমাদের
সবার মাথায় হাত বুলান। অতঃপর মাকে
ডেকে বললেন "আছিয়া, প্রাণপণ
চেষ্টা করেও চালা বেড়া মেরামত
করতে পারলামনা। আহ সামনে বর্ষা
মৌসুমে ঝড় তুফানের সময় আমার
প্রানের ধন বাচ্চাদের নিয়ে
কিভাবে পাড়ি দেবে। রফিক
মাষ্টারের ১২০ টাকা ঋন। কদম গাছটা
বিক্রয় করে ঋন পরিশোধ করবে। আহ
কাপনের কাপড়ের জন্য একটি কড়িও
রেখে যেতে পারলামনা। তোমাকে
একটা শাড়ী ও কিনে দিতে
পারলামনা। বাচ্চাদের দু'মুঠো ভাতের
ব্যবস্থা ও করে যেতে পারলামনা।
আল্লাহর কুদরতি হাতে তোমাদের
সোপর্দ করলাম।
বাবার কথাগুলো শুনে মা কাঁদতে
লাগলেন, মায়ের কান্না দেখে আমরা
ও কাঁদতে লাগলাম। এমন সময় সফেদ
চাদরে আবৃত নূরানী চেহারার, দেখতে
প্রায় আপনার মত, পাহাড়ি দরবেশ
হন্তদন্ত হয়ে আল্লাহ আল্লাহ জিকির
করতে করতে আমাদের ঘরে প্রবেশ
করলেন, তার কাছে জমজমের পানি
ভর্তি পানির বোতল ছিল, সেই বোতল
থেকে এক চামচ পানি বাবার মুখে
দিয়ে কালেমা পাঠ করালেন। বাবা
তার সাথে কালেমা পাঠ করতে
করতে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করলেন। বাবার মরনের পর ফেরেস্তা
তুল্য সেই মহান দরবেশ আমাদের নিয়ে
রাব্বে কারিমের দরবারে চোখের
পানি ফেলে মোনাজাত করতে করতে
প্রায় বেহুঁশ হয়ে গেলেন। শেষ রাতে
আমাদের কাছে বাবার কাপনের
কাপড়, আতর, চন্দন, সাবান, কর্পুর, সহ দাফন/
কাপনের সব সরঞ্জাম রেখে জিকির
করতে করতে বালাই হাওরের
পাহাড়ের দিকে চলে গেলেন।
তারপর?
তার পরদিন গভীর রাতে দরবেশ আবারও
আমাদের খোঁজ নিতে আসলেন। তার মুখ
ঢাকা ছিল এবং গায়ে মোটা
একখানা সাদা চাদর ছিল। তিনি
আমাদের সবার জন্য জামা নিয়ে
আসেন, মায়ের জন্য শাড়ী, বড় বোন এবং
ছোট বোনের জন্য সবুজ রঙের জামা,
আমার জন্য এবং আমার একমাত্র ছোট
ভাই ফারহানের জন্য ছিল সাদা
পান্জাবি, লুঙ্গি এবং টুপি। সাথে
আরোও কিছু সওদা পাতি নিয়ে
আসেন, এক বস্থা চাল, ডাল, লবন, তৈল,
পেয়াজ আরো যে কত কি!!
দরবেশ জিজ্ঞেস করলেন, পাহাড়ি
দরবেশ কি শুধু তোমাদের বাড়িতেই
আসেন?
সাদিকের এতিম ছেলে বলল; না। লোক
মুখে শুনেছি তিনি আমাদের মতো
অনাথের ঘরে বিপদে আপদে সব সময়
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আসেন।
রাতের গভীরে হযরত উমর (রাঃ) এর মত
গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চষে বেড়ান।
দুর্যোগের সময় খাদ্যদ্রব্য কাঁদে করে এক
বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি, এক পাড়া
থেকে অন্য পাড়ায় আমাদের মত অনাথ
এতিমের ঘরে ঘরে যান। অনাথ
এতিমের ঝুপড়ি ঘর নিজ হাতে মেরামত
করেন। দিনমজুর গরীব মানুষের মরনের সময়
তিনি জমজমের পানি, কাপনের
আসবাবপত্র নিয়ে উপস্থিত হন। তিনি
মাঝে মাঝে রাতের গভীরে গ্রামের
দক্ষিন পাশের মধুমালতির তীর ঘেঁষে
যে কবরিস্থান সেখানে দাড়িয়ে
দু'হাত তুলে চুখের পানি ফেলে কার
সাথে যেন কথা বলেন। কখনো কখনো
রাতের গভীরে মানুষের ঘরের পাশে
লাউ, কুমড়া, শিম, শসার বীজ রোপন
করেন। এইতো সেদিন আমাদের ঘরের
পাশে এসেও বীজ রোপন করে গেলেন।
এতিমের কথা শুনে দরবেশের দু'চোখ
বেয়ে পানি পড়তে লাগল। দরবেশ
এতিমদের আদর করে কোলে নিয়ে
বললেন আমি যদি তোমাদেরকে আমার
আস্তানায় নিয়ে যেতে চাই তোমরা
কি যাবে? তোমাদের মত হাজারো
এতিম আমার আস্তানায় তোমাদের জন্য
অপেক্ষা করছে। সেখানে হাজারো
এতিমের সাথে আমরা সুখ দুখ ভাগ করে
জীবন অতিবাহিত করব। দরবেশের কথা
শুনে সাদিকের এতিম ছেলেরা
মায়ের আছল ধরে অনুমতি চাইলে মা
বললেন, চলে যা তোরা তোদের নিজ
ঘরে। সেখানে তোর বাবা ভাই
বোনেরা অপেক্ষা করছে। মায়ের কদম
চুমে সাদিকের এতিম সন্তানেরা
অনাবিল এক শান্তির উদ্দ্যেশ্যে
দরবেশের হাত ধরে অজানা গন্থব্যের
দিকে পা বাড়ালো । দরবেশ
তাদেরকে নিয়ে বালাই হাওর
অতিক্রম করে ছুঠলেন সেই মায়া ঘেরা
আস্তানার দিকে, হাজারো এতিমের
মিছিলে। ...
 
Top